ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি বিশ্লেষণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণে পারস্পরিক মতবিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি বিশ্লেষণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণে পারস্পরিক মতবিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা – ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে জওহরলাল নেহরুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে সেই শাসনের সমাপ্তি ঘটে।

যখন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ প্রদেশগুলিকে ভাগ করে দুটি অধিরাজ্য বা ডমিনিয়ন সৃষ্টি করা হয়। এই দুটি ছিল যথাক্রমে ভারত অধিরাজ্য ও পাকিস্তান অধিরাজ্য। দেশীয় রাজ্যগুলিকে এই দুটি দেশের মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এই অধিরাজ্য দুটি পরবর্তীকালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান-এ পরিণত হয়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের তাত্ত্বিকেরা আরেকটি বিষয় বড় করে দেখাতে চান, ব্রিটিশরাই পুরো ভারতবর্ষকে এক শাসনের অধীনে নিয়ে এসেছিল। তাঁদের ব্যাখ্যা, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত ভারতে একগুচ্ছ রাজত্ব ছিল। ব্রিটিশ শাসনই ভারতকে একত্র করে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এমন মন্তব্যও করেছেন যে ব্রিটিশরা আসার আগপর্যন্ত কোনো ভারতীয় জাতি ছিল না। ভারত ছিল একটি ভৌগোলিক ধারণা।

এটি সত্যি হলে ব্রিটিশরাজ স্পষ্টত একত্রীকরণে ভূমিকার মধ্য দিয়ে ভারতের আধুনিকায়নে পরোক্ষ অবদান রেখেছে। কিন্তু ভারতের একত্রীকরণে ব্রিটিশরাজের ভূমিকা নিয়ে এই দাবি কি সঠিক? এভাবে দেখলে ভারতের ইতিহাস প্রকৃত সত্যের বিপক্ষে যাবে। হাজার বছর ধরে এখানকার বড় বড় শাসক তাদের সাম্রাজ্যকে ভারতবর্ষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে উচ্চাভিলাষী ও প্রতাপশালী সম্রাটেরা যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো দেশ তাঁদের অধীনে না আসছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের শাসনকে পূর্ণাঙ্গ মনে করতেন না। গুপ্ত সম্রাট অশোক মৌর্য, মোগল সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজিসহ অন্যদের এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাই আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণা করা উচিত হবে না যে আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতে যে বিভক্ত শাসনব্যবস্থা দেখা যায়, তা ব্রিটিশরা এসে এক করার আগপর্যন্ত ইতিহাসজুড়েই ছিল।

পলাশীর যুদ্ধের খুব অল্প সময়ের মধ্যে ‘বাংলার অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ’ শুরু হয়। তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নবাবদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু রাজস্বই নয়, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ পায়। এর বাইরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নিয়মিত তারা কথিত উপঢৌকন পেতে থাকে। ভারত থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চিত্র উঠে আসে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের পর্যালোচনায়। তিনি লিখেছেন, ১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন গড়ে তোলা হয়, তখন বিশ্ব জিডিপিতে ব্রিটেনের অবদান ছিল ১ দশমিক ৮ শতাংশ, আর ভারতের ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। যখন ব্রিটিশরাজের শাসন চূড়ায় তখন চিত্র উল্টো। ভারত তখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী দেশ থেকে ‘দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে’ পরিণত হয়েছে।

বাংলা থেকে লুট করা অর্থ ব্রিটিনে চলে যেত। এর সুবিধাভোগী ছিল ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃত্ব। পলাশী যুদ্ধের পর দেখা গেল, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ার কিনেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ব্রিটেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থেকে ভারত অনেক কিছুই অর্জন করেছে। যেমন শেক্‌সপিয়ারের নাটক, বায়রনের কাব্য নিয়ে আলোচনা এবং মোটের ওপর…উনিশ শতকের ইংরেজ রাজনীতির বিশাল উদারতাবাদ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, প্রকৃত সত্য হচ্ছে যে তাদের নিজেদের সভ্যতায় যেটা সবচেয়ে বড়—মানুষ মানুষের সম্পর্কের মর্যাদাকে সমুন্নত রাখা, তার কোনো স্থান এ দেশে ব্রিটিশ প্রশাসনে ছিল না।