একজন আদর্শ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা নির্ভর করে ব্যবস্থাপনার নীতি গুলো সঠিক প্রয়োগের ওপর কথাটির- যথার্থতা মূল্যায়ন
উত্তরঃ
ক) ব্যবস্থাপনা নীতির ধারণাঃ
নীতি হল একটি রূপরেখা যা ব্যবসায় পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করে।অর্থনীতি অর্থ হলাে নিয়ম বিধান। আর ব্যবস্থাপনার নীতিমালা হচ্ছে ব্যবস্থাপকীয় কার্যাবলী সুষঠুভাবে সম্পাদনের মৌলিক বিবৃতি। হঠাৎ ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী সম্পাদন করার ক্ষেত্রে যে সকল রুপরেখা বা নিয়ম অনুসরণ করতে হয় তাই হল ব্যবস্থাপনার নীতিমালা। বিভিন্ন ব্যবস্থাপনাবিদ, ব্যবস্থাপনা নীতির বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ১) জি আর টেরি এবং ফ্রাঙ্কলিন-এর মতে, নীতি হচ্ছে একটি মৌলিক বিবরণী বা সত্য যা ভাবনা বা কার্যের দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কার্যাদি কতগুলাে আদর্শবান নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ স্ব-স্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবস্থাপনার মূলনীতি সম্পর্কে আলােকপাত করলেও ১৯১৬ সালে ফরাসি প্রকৌশলী আধুনিক ব্যবস্থাপনার জনক হেনরি ফেওল কর্তৃক প্রদত্ত ১৪ টি নীতি কে অদ্যাবধি গ্রহণযােগ্য সর্বজনীন ও কার্যকর নীতি হিসেবে অভিহিত করা হয়। আধুনিক ব্যবসায়ের জটিলতা ও পরিবর্তনশীল অবস্থার কারণে ব্যবস্থাপনা নীতি সমূহের সম্প্রসারণ ঘটেছে। তাই হেনরি ফেয়ল প্রদত্ত ১৪ টি নীতি ছাড়াও আধুনিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞগণ ব্যবস্থাপনার আরাে কতিপয় প্রয়ােজনীয় নীতির উল্লেখ করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য অনুসরণকৃত নীতি হলাে ব্যবস্থাপনার নীতিমালা।
খ) ব্যবস্থাপনার মূলনীতি বা আদর্শ সমূহ
১. উদ্দেশ্যের নীতি
প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যের সাথে মিল রেখে এর বিভাগ ও শাখা সমূহের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হবে। পরে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যথাযথ নীতি তৈরি করতে হবে।
২. কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের নীতি
কোন ব্যবস্থাপককে কোন কার্য সম্পাদনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলে তাকে অবশ্যই কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দিতে হবে। মোটকথা, কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে।
৩. পরিকল্পনা নীতি
পরিকল্পনা ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জন করা যায় না। এ কারণে পরিকল্পনাকে উদ্দেশ্য অর্জনের রূপরেখাও বলা হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও নীতির প্রয়োজন হয়।
৪. সমন্বয়ের নীতি
প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সমন্বয়ের কারণে সম্পদের সদ্ব্যবহার হয় এবং সহজে উদ্দেশ্য/লক্ষ্য অর্জন করা যায়। প্রতিষ্ঠানের ভিতরে আন্ত:বিভাগীয় সমন্বয়সাধন নিশ্চিত করার জন্য সমন্বয়ের নীতি অনুসরণ অপরিহার্য। প্রতিটি বিভাগের কাজের মধ্যে মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়বিধান করা না হলে কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
৫. প্রেষণার নীতি
আর্থিক ও অনার্থিক প্রণোদনা দিয়ে কর্মীদের উৎসাহ প্রদান করে উদ্দেশ্য হাসিল করা প্রয়োজন। প্রেষণা নীতির মাধ্যমে প্রণাদনার পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়।
৬. সহযোগিতার নীতি
এ নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের এক নির্বাহীর সাথে অন্য নির্বাহীর, এক বিভাগের সাথে অন্য বিভাগের এবং উর্ধতন ও অধঃস্তনের মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করা হয়। এতে প্রতিষ্ঠানে দলীয় উদ্যম বৃদ্ধি পায় এবং কাজের গতি বেড়ে যায়।
৭. ভারসাম্যের নীতি
এ নীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি বিভাগ ও কর্মীদের কার্যভার সুষম করা হয়। কেননা ভারসাম্যের অভাবে কর্মীদের মধ্যে অনেক সময় কাজের প্রতি অনীহা আসতে পারে। ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে পারে।
গ) বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতিমালাঃ
ব্যবস্থাপনার গর্ভানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি প্রয়ােগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সকল দিকে দক্ষতা অর্জন করাই হলাে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা। ১৯১২ সালে টেইলর এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, শীঘ্রই অথবা অদূর ভবিষ্যতে গতানুগতিক পদ্ধতির স্থলে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও পদ্ধতির ব্যবহার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ব্যবস্থাপনায় এফ. ডব্লিউ. টেইলর ১৯১১ সালে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Principles of Scientific Management’ এ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার কতিপয় নীতি বা আদর্শ তুলে ধরেন, যা নিম্নরূপ
১. গতানুগতিক হাতুড়ে পদ্ধতির পরিবর্তে প্রতিটি কাজে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহারঃ কর্মক্ষেত্রে গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরণের চেয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা কর্মপন্থা অনুসরণ করা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপকের কার্যাবলী গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ করায় এই নীতির মূল উদ্দেশ্য।
২. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কর্মী নির্বাচন, প্রশিক্ষন দান ও তাদের উন্নয়নঃ যেকোনাে প্রতিষ্ঠানের সফলতা অনেকাংশেই তার কর্মীদের উপর নির্ভর করে। দক্ষ কর্মী বাহিনী পারে প্রতিষ্ঠানের সফলতা অর্জনে সহায়তা করতে। তাই কর্মী নির্বাচনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করায় এই নীতির আলােচ্য বিষয়।
৩. ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে সউহার্দ্য সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাঃ ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৈজ্ঞানিক মূলনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি।
৪. ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে ও কর্তব্যের সুষ্ঠ বন্টনঃ এই নীতিতে ব্যবস্থাপনা ও কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুষ বন্টন এর কথা উল্লেখ রয়েছে। কর্মীদেরকে কর্তব্যের পাশাপাশি ক্ষমতাও প্রদান করা এই নীতির মূল উদ্দেশ্য।
ঘ) ব্যবস্থাপকের দক্ষতা বিচারে আধুনিক ব্যবস্থাপনার ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনারনীতি বিশ্লেষণঃ
যে কোন প্রতিষ্ঠান সফলতা নির্ভর করে ঐ প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপকের উপর। মূলত প্রতিষ্ঠানের সকল নিয়ম-নীতি ব্যবস্থাপক অর্পণ করে থাকেন। এজন্য ব্যবস্থাপককে অবশ্যই দক্ষ হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে কোন প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপক নিয়ােগের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কর্ম ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া মূলত ব্যবস্থাপক নিয়ােগ দেওয়া হয় না। ব্যবস্থাপকের দক্ষতা বিচারের ক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবস্থাপনার ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে ব্যবস্থাপকের দক্ষতা বিচারে আধুনিক ব্যবস্থাপনার ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার নীতি বিশ্লেষণ করা হলােঃ
১) কারিগরি দক্ষতাঃ প্রতিটা কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি, কৌশল বা যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারা কারিগরী দক্ষতা হিসেবে গণ্য। ব্যবস্থাপকের কারিগরি দক্ষতার বিষয়টি আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি মধ্যে এমন ভাবে আলােচনা করা নেই। কিন্তু এই বিষয়টিকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতির মধ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২) মানবীয় আত্ম ব্যক্তিত্ব দক্ষতাঃ মানবীয় আত্মব্যক্তিক দক্ষতা বলতে ব্যক্তি বা দলকুে বুঝে সে ভাবে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা, নিজস্ব চিন্তার প্রতি তাদের সমর্থন আদায়, প্ররােচিত ও উৎসাহিত করার দক্ষতা কে বােঝায়। ব্যবস্থাপকের এর দক্ষতা টি আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতির। সাথে তেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতির দ্বারা ব্যবস্থাপকের এ দক্ষতাটি পরিমাপ করা যায়।
৩) সমস্যা অনুধাবন্তের দক্ষতা প্রতিষ্ঠান সর্বোদয় নানান ধরনের সমস্যা লেগেই থাকে। এর মধ্যে অনেক সমস্যা অনেক সময় অপ্রকাশিত থাকে একজন দক্ষ ব্যবস্থাপকের দক্ষতা দিয়ে অনুধাবন করতে হয়। অনুধাবনের এই বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতির মধ্যে কর্মী নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের সাথে জড়িত। উপরিউক্ত আলােচনা হতে বলা ঋয় যে, ব্যবস্থাপকের দক্ষতা বিচারে আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা অধিক তাৎপর্যপূর্ণ।